বাংলাদেশ নামক দেশটিকে মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালা প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি তাঁর রহমতের বহু কিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো মানব সম্পদ। সেগুলোর মধ্যে ইসলাম ধর্মের মহা সাধক, আউলিয়া, দরবেশ, সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাসহ বহুমূখী প্রতিভার অসাধারণ ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। তা নাহলে এদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সমর্থ হতো না। আল্লাহর দানে কোন কার্পণ্য নেই, কিন্তু আমরা মানুষেরা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেগুলোর সদ্বব্যবহারে। প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য আমাদের সেনাবাহিনী যে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছে, একই ভাবে এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের জন্য এক নব যুগের উত্থান শুরু হয়েছিল। এটা ছিল আমাদের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত অন্যতম নেয়ামত ও রহমত। পলাশীর প্রান্তরে বৃটিশ বেনিয়াদের নিকট পরাজয়ের পর দীর্ঘ দুইশত বছর মুসলিমরা যে শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার,নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়েছিল,১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখ হতে সে বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে বের হবার পথ খুলে দেন মহান আল্লাহ্। এরপর ১৯৭১ সাল। শুরু হলো নতুন দেশ গড়ার দুর্ধর্ষ অভিযাত্রা। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর গড়ার কাজ। সে সময়েই প্রয়োজন হলো দেশপ্রেমিক,পেশাগত সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ সংগঠকগণের। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সুসংগঠিত করে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মরহুম রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান,(TAS), psc, BN (Retd) (P No 3) এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর তৃতীয় প্রধান। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি দক্ষতার সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশ উন্নয়ণে ব্যাপক অবদান রাখেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জলসীমা সুরক্ষা,সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপের দখল রক্ষা, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের পুণঃ দখল নিশ্চিত করা,সমুদ্র উপকুল ও সুন্দরবন এলাকাকে জলদস্যু মুক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি আধুনিক ও শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে মর্যাদা লাভ করে। এমনকি সেই সময় ভারতীয় নৌবাহিনীও বাংলাদেশের নৌসীমায় প্রবেশের দুঃসাহস দেখায়নি। রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী হিসেবেও অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশের বহুবিধ উন্নয়ণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পৃথিবীতে বহু মহান ব্যক্তি স্মরণীয়,বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের কাজের মাধ্যমে। তেমনি সততা, নিষ্ঠা,সাহসিকতা, নির্ভীক দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা আর জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আজো আসন গেড়ে আছেন মরহুম রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান। গভীর দেশপ্রেম, অসীম সাহসিকতা আর মানবিক মূল্যবোধের এক অসাধারণ সম্মিলনে নিজেকে উদ্ভাসিত করে দেশের মানুষের নিকট স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন মরহুম রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ।
পারিবারিক পরিচয়: মাহবুব আলী খানের রয়েছে অবাক করার মতো পারিবারিক ঐতিহ্য। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন বৃটিশ ভারতের সিলেটের বিরাহীমপুরের এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারেজন্মগ্রহণ করেন। সিলেটের বিরাহীমপুর, কলকাতা ও ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ৬৭ পুরানাপল্টন লাইনের বাড়িতে মাহবুব আলী খানের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়। মাহবুব আলী খানের বাবা ছিলেন উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান। যিনি ১৯০১ সালে ব্যারিস্টার হন। তিনি নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এম এল এ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আহমেদ আলী খানের অপর ভাই গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ভারতে চতুর্থ মুসলিম হিসেবে আই সি এস লাভ করেন এবং তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে ‘অফিসার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং ‘‘সি আই ই’ উপাধিতে ভূষিত করেন। শেরে সিলেট ও অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরী ছিলেন তার চাচাতো ভাই। দু’ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাহবুব আলী খান ছিলেন ছোট। বড়বোন সাজেদা বেগম। মেজভাই চিকিৎসক সেকেন্দার আলী খান। সেকেন্দার আলী খানের মেয়ে আইরিন খান কাজ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব হিসেবে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মতামত সংক্রান্ত বিশেষ রেপুটিয়ারের দায়িত্ব লাভ করেছেন আইরিন খান। মাহবুব আলী খানের দাদা ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট চিকিৎসক খান বাহাদুর ডা.আছদ্দর আলী খান। যিনি ছিলেন বিহার ও আসামের দারভাঙ্গা মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। ১৯২৪ সালে তিনি সিলেটে নাফিজাবানু চ্যারিটেবল হাসপাতাল ও ১৯৩০ আরেকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। মাহবুব আলী খানের পিতা আহমেদ আলীর মামা তৎকালীন ভারতের সুবিখ্যাত লেখক,আইনজীবি ও বিচারপতি আমীর আলী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। সুবিখ্যাত গ্রন্থ The Spirit of Islam (editions in 1891, 1922, 1953), A Short History of Saracens (1899), A Critical Examination of the Life and Teachings of Mohammed (1873), The Personal Law of Muhammedans (1880), Islam (1906), The Legal Position of Women in Islam (1912) এ সকল অসাধারণ বই রচনা করে আজও তিনি ইতিহাসের পাতায় খ্যাতির শীর্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ছিলেন মাহবুব আলী খানের চাচাতো ভাই।

মায়ের দিক থেকেও মাহবুব আলী খান ছিলেন বর্ণাঢ্য পারিবারিক ঐতিহ্যের এক গর্বিত উত্তরাধিকার। তাঁর মা ছিলেন জোবায়দা খাতুন। যিনি ছিলেন অবিভক্ত বিহার, আসাম, উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদের কণ্যা। জোবায়দা খাতুনের দাদা সমাজকল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন বৃটিশদের রাজকীয় খেতাবে ভূষিত হন । মাহবুব আলী খানের পিতার চাচা গজনফর আলী খান ১৮৯৭ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আই.সি.এস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন বাংলা ও আসামের প্রথম মুসলিম আই.সি.এস অফিসার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৩২ সালে গজনফর আলী খান নাগপুর ডিভিশনের কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘অফিসার অব দি বৃটিশ এম্পায়ার’ এবং সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৫৫ সালে ২১ বছর বয়সে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন সৈয়দা ইকবালমান্দ বানুর সাথে। দুই কন্যা সন্তানের জনক মাহবুব আলী খান। শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা জোবায়দা রহমান (ঝুনু)। শাহিনা খান জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কনিষ্ঠা কন্যা জোবায়দা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত সোয়াস থেকে তিনি প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজি থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। এতে বিশ্বের ৫২টি দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্জন করেন প্রথম স্থান। বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর সৈয়দ শফিউজ্জামান মাহবুব আলী খানের জ্যেষ্ঠ জামাতা। জিয়াউর রহমানের বড় ভাই রেজাউর রহমান নৌবাহিনীতে মাহবুব আলী খানের সহকর্মী ছিলেন। সে সুবাদে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানেরও ছিল নিবিড় সম্পর্ক। এর ফলে মাহবুব আলী খানের কনিষ্ঠ কন্যা ডাঃ জুবাইদা খান আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাহবুব আলী খানের কনিষ্ঠ জামাতা। মাহবুব আলী খানের একমাত্র নাতনী ব্যারিস্টার জায়মা রহমান।
শিক্ষা জীবন: পিতার কর্মস্থল কলিকাতায় শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। পরবর্তীতে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। অতঃপর তিনি ঢাকাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং সুবিখ্যাত ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। বরাবরই পড়াশোনায় তিনি ছিলেন কৃতি ছাত্র। সারাজীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কখনো কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি ।
পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে যোগদান: ১৯৫২ সালে মাহবুব আলী খান ক্যাডেট হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করেন কোয়েটার সম্মিলিত বাহিনীর স্কুল থেকে। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। যুক্তরাজ্যের ডরমাউথ রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রায়ামপতে ১৯৫৪ সালে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের মে মাসে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পি.এন.এস (পাকিস্তানি নেভাল শীপ্)তুগ্রিলের গানারি অফিসার ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের গ্রিনউইচের রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে বিভিন্ন পেশাগত কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে যুক্তরাজ্যের এইচএমএস ভার্নন থেকে টর্পেডো-অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারে স্পেশালাইজেশন কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন এবং যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে একজন সুশৃঙ্খল অফিসার হওয়ার জন্য বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করেন। তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নেভাল স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স এবং করাচির ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট থেকে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স করেন। ১৯৬৪ সালে পি.এন.এস.টিপু সুলতানের টর্পেডো ও এন্টি সাবমেরিন অফিসার ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফস সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারি এসিস্ট্যান্স) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে পি.এন.এস. হিমালয়ে টর্পেডো ও এন্টি সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইনচার্জ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে সিওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু আগেই মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও দু’কন্যাসহ মাহবুব আলী খান কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানিরা তখন বাঙালি অফিসারদেরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। মাহবুব আলী খান যখন দেশ মাতৃকার টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই তাঁকে সপরিবারে গৃহবন্দী করা হয় সেনানিবাসে । এ অবস্থায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য এবং সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন । দীর্ঘ ২ বছর বন্দিজীবন শেষে ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও দু’কন্যা বিন্দু ও বিনুসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী সংগঠক হিসেবে: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুণী ব্যক্তিগণকে খুবই পছন্দ করতেন। দেশের ও সামরিক বাহিনীর উন্নয়ণের প্রয়োজনে তিনি সকল পেশাগত দক্ষ ও গুণী ব্যক্তিত্বকে সম্পৃক্ত করতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল মাহবুব আলী খানের সুসম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় পাকিস্তানে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে বাংলাদেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে নৌবাহিনী সুসংগঠিত ও আধুনিকায়ন করার বিশেষ দায়িত্ব দেন। জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে চাচাত ভাই হওয়ায় নৌবাহিনীর উন্নয়নে আরও বেশি কাজ করতে পেরেছেন মাহবুব আলী খান। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে তিনি চট্টগ্রামে মার্কেন্টাইল একাডেমির প্রথম বাংলাদেশী কমান্ড্যাট হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দফতরে পার্সোনাল বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারী স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনাল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বি.এন.এস (বাংলাদেশী নেভাল শীপ্) ‘ওমর ফারুক’এর (প্রাক্তন এইচ. এম. এস ন্যাভডকে) অধিনায়ক নিযুক্ত হন মাহবুব আলী খান। এ রণতরী নিয়ে আলজেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোয় শুভেচ্ছা সফরের পর দেশে ফিরে আসেন।

নৌ-বাহিনী প্রধান: ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর মাহবুব আলী খান বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৃতীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি রিয়ার অ্যাডমিরাল পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতাত্তোর নৌবাহিনীকে সুসংগঠিত করে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য যুগোপযুগী আইন প্রণয়ন করেন। ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমায় দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ জেগে ওঠার পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশের সরকারই দ্বীপটিকে তাদের মালিকানা বলে দাবি করে। অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের দেশপ্রেম ছিলো প্রশ্নাতীত। দেশের অখন্ডতা,সার্বভৌমত্বের অংশ হিসেবে সমুদ্রসীমা রক্ষায় ইঞ্চি পর্যন্ত ছাড় তিনি দেননি। তাঁর দুঃসাহসীক নেতৃত্বে এ গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপটি নৌবাহিনী বাংলাদেশের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। যা তাঁর নিখাঁদ দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে অনেক জলদস্যুর পতন এনেছেন তিনি। সুন্দরবনের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন-ভাতা ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন বেতন কাঠামোর সুপারিশকারী।
মাহবুব আলী খান খেলাধুলার প্রতি বরাবরই প্রচণ্ড আসক্ত ছিলেন। তরুণ বয়সেই খেলেছেন ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও হ্যান্ডবল। টেনিস আর সুইমিংয়ের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। হ্যান্ডবল এসোসিয়েশনের প্রধান ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে এসময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সফল আয়োজন করার কৃতিত্ব তাঁর।

রাজনীতিতে যোগদান: শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানের সম্পর্ক ছিল অতন্ত ঘনিষ্ঠ। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের পর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের সময় নৌবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা ছিলেন। মাহবুব আলী খান শহীদ জিয়া সূচিত সবুজ বিপ্লব ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম সহযোগি হিসাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সৎ ও অভিজ্ঞ মাহবুব আলী খানকে পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করে। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া জাগদলের সদস্য ছিলেন। সরকারি চাকরিরত অবস্থায় জাগদল-এ দায়িত্বশীল পদে আসীন হননি। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারিকালে অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেশের সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেন। এসময় শাহজালাল সেতু, লামাকারী সেতু ও শেওলা সেতুসহ অসংখ্য ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ করে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। এসময় তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবুজ ও কৃষি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কাজ করেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, কৃষি বিপ্লব, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। দেশের প্রশাসনিক এলাকা ও তা পুনর্গঠনের জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদ সরকারের সময় তিনিই প্রথম উপজেলা পদ্ধতির প্রবক্তা ও চালু করার পরিকল্পনা করেন। সুতরাং মানুষের দোরগড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যেতে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ গঠনে মাহবুব আলী খানের শ্রম-ঘামের স্বাক্ষী এই জনপদ। ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নৌ, রেল ও সড়ক প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। একই বছর নভেম্বরে তিনি রাশিয়া গমন করেন এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসেম্বরে জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইনবিষয়ক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন ও কনভেনশন অন অফ-সি কনফারেন্সে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আহমদ সেকুতুরের শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

সমাজ উন্নয়নে ব্যাপক অবদান: নৌবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল । সমাজের অবহেলিত শিশুদের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ‘সুরভি’ মাহবুব আলী খানের অনুপ্রেরণায়ই গড়ে উঠেছে । স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় কন্যা শাহিনা খান জামান ‘সুরভি’ এর মাধ্যমে ছিন্নমূল অসহায় শিশুদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন । পারিবারিক জীবনে মাহবুব আলী খান ছিলেন খুবই সাধারণ । স্বামী হিসাবে তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুপ্রতিম। পরিবারের প্রত্যেকের মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। এমনকি ছোটদের মতামতকেও প্রাধান্য দিতেন । বড় ভাই-বোন ও শাশুড়ির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল । স্নেহময় পিতা হিসেবে সন্তানদের নিয়মানূবর্তিতা শিক্ষার উপর বেশ গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার পাশাপাশি শৃংখলা মেনে চলা সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। মানব কল্যাণের কাজে তাঁর দু’কন্যা শাহিনা খান জামান ও জুবাইদা রহমানকে ছোটবেলা থেকেই উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘বড় কিছু পাওয়া মানে অহংকারী না হওয়া’। বিনয় নম্রতা ছিল মাহবুব আলী খানের সবচেয়ে বড় গুণ। সন্তানদেরকে সর্বদা বিনয়ী হবার শিক্ষাই দিয়েছেন। ছোট-বড় সবার সাথে সমান ভাবে মেশার শিক্ষাও তিনি সন্তানদের দিয়েছেন। নারীশিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। স্ত্রী সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকে বিবাহের পরেও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় তিনি ফাইন আর্টসে পড়াশুনা শেষ করে দেশের শিল্প-সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পী হিসাবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
পরলোক গমন: ১৯৮৪ সালের ৬ আগস্ট ঢাকায় খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণ করার সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) কাছাকাছি একটি জলাভূমির মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পূর্বনির্ধারিত ঘরোয়া যাত্রী ফ্লাইট পরিচালনা করছিল। সে ঘটনায় মোট ৪৯ জন যাত্রি মৃত্যুবরণ করেন। ফ্লাইট পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পাইলট কানিজ ফাতেমা রোকসানাও মর্মান্তিক ওই বিমানদূর্ঘটনায় নিহত হন। রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান তাৎক্ষণিক ছুটে
যান দূর্ঘটনাস্থলে। সেসময় তাঁর হৃদযন্ত্রের ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই ক্ষণজন্মা পুরুষ। সেখানে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন নিভৃতচারী এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। রেখে যান কর্ম, উদ্যম, সততা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের অনন্য নজির ।
রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের মতো অসাধারণ দেশপ্রেমিক সামরিক ও জননেতার সংখ্যা খুবই কম। নীরবে নিভৃতে মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। যশ-খ্যাতি, প্রতিপত্তি তাঁকে তাড়া করলেও তিনি সেগুলোর প্রতি ফিরেও তাকাননি।বাংলাদেশ যতদিন থাকবে,বাংলাদেশের গর্ব রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান তার দেশপ্রেম, বীরত্ব, সাহসিকতা, জনকল্যাণমূলক কাজ ও মহানুভবতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com