ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো এই উত্তর প্রদেশ। ভারতের জনগণের মোঝে জনশ্রুতি আছে, উত্তর প্রদেশ যার, দিল্লি তার। আগামী ২০২৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে ‘সেমিফাইনাল’ নির্বাচন হিসেবে। সম্প্রতি নির্বাচনের জন্য উত্তর প্রদেশ কতটা প্রস্তুত তা খতিয়ে দেখতে সেখানে তিন দিনের সফরে যান ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুশীল চন্দ্র। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানান, নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর প্রদেশে নির্বাচন হওয়ার জন্য সহমত পোষণ করেছে সব রাজনৈতিক দল। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার গুঞ্জন ছিল—তার অবসান হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে কয়েক ধাপে নির্বাচন উত্তর প্রদেশে নির্বাচন হবে। কোভিড বিধি মেনে নির্বাচন করার ব্যাপারে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হবে। এবারের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে বলে জানিয়েছেন মুখ্য নির্বাচনি কমিশনার। কারণ উত্তর প্রদেশে গত বিধানসভা ও শেষ লোকসভা নির্বাচনে ভোট পড়ার হার কম হওয়ায় কমিশনের উদ্বেগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের পর থেকে উত্তর প্রদেশে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিজেপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো আগে থেকেই তাদের নির্বাচনি তত্পরতা শুরু করেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে, উত্তর প্রদেশে নারীদের ভোটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে। দল নির্বিশেষে প্রমীলা ভোটব্যাংক দখলের এই চেষ্টা এর আগে দেখা যায়নি বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন নারী কল্যাণ প্রকল্পকে প্রচারে সামনে নিয়ে আসছেন। রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ইস্তেহারে মহিলাদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন। জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় এলে (এসপির সঙ্গে জোট গড়ে) সরকারি চাকরিতে ৫০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, সরকারি স্কুলে মেয়েদের বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। বিএসপির নেত্রী মায়াবতী হঠাত্ বিজেপি এবং কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেছেন, সংসদে নারী সংরক্ষণ বিল পাস না করানোর জন্য! এমনকি, যে দলের নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করেছিলেন, সেই সমাজবাদী পার্টির বর্তমান নেতা তথা মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ যাদব এখন প্রতিটি প্রচারে নারী কল্যাণকে সামনে নিয়ে আসছেন। হঠাত্ করে পুরুষতান্ত্রিক উত্তর প্রদেশে নারী কল্যাণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো জোর দিচ্ছে কেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু উত্তর প্রদেশেই নয়, গোটা ভারতের নির্বাচনে ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছেন নারীরা। মমতা ব্যানার্জি, নবীন পট্টনায়ক, নীতীশ কুমারের মতো নেতা-নেত্রীরা তা আগেই বুঝতে পেরেছেন। উত্তর প্রদেশে ২০১৭ সালের বিধানসভা এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে, নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। বিজেপি সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে, বহু রাজ্যেই নারী ভোট তারা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির উজ্জ্বলা যোজনা অথবা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কারণে। এই প্রকল্পগুলোতে নারীদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা হয়েছে। এছাড়া নারীদের আকৃষ্ট করতে আরো বেশকিছু কর্মসূচি বা প্রকল্পও নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের একটি জনসভায় নরেন্দ্র মোদি বলেন, রাজ্যের মহিলাদেরই এটা নিশ্চিত করতে হবে যাতে বিরোধীরা ক্ষমতায় না আসেন। একটু দেরিতে হলেও সীমিত সাধ্যের মধ্যে এই দৌড়ে নেমেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। তার প্রতিশ্রুতি, ৪০ শতাংশ নারীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে তার দল। এছাড়া ভোটে জিতলে মেয়েদের স্মার্ট ফোন, গ্যাস সিলিন্ডার, সাইকেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এসপি প্রধান অখিলেশ যাদব তার প্রচারণায় বারবারই নারী কল্যাণের প্রসঙ্গ তুলছেন। উত্তর প্রদেশে এখন বিজেপির সরকার। নির্বাচনের এখনো দেরি। তার পরও উত্তর প্রদেশের এবারের নির্বাচনের ফল নিয়ে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ। গতকাল রবিবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে সহজ জয় পেয়ে আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট। সেটা হলে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ১৯৮৫ সালের পর টানা দ্বিতীয় বারের মতো উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। ভোটের সাহায্যে জরিপটি করেছে টাইমস নাও নবভারত। জরিপ অনুযায়ী বিজেপি জোট ৪০৩ বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৩০ থেকে ২৪৯টি আসনে জয় পেতে পারে। সমাজবাদী পার্টি পেতে পারে ১৩৭টি থেকে ১৫২টি। জরিপের ফল বলছে, নির্বাচনে ছিটকে পড়বে বিএসপি ও কংগ্রেস। বিএসপি পেতে পারে ৯-১৪ আর কংগ্রেস পেতে পারে মাত্র চার থেকে সাতটি আসন। তবে ২০১৭ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার বিজেপি জোটের মোট ভোট কমতে পারে। আর গত বারের চেয়ে এবার বেশি ভোট পেতে পারে এসপি জোট। বিজেপির এগিয়ে থাকার কারণ বলা হচ্ছে—যোগী সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। যদিও লখিমপুরে কৃষক সমাবেশে বিজেপি নেতার ছেলের গাড়ি তুলে দেওয়ার ঘটনায় বিজেপি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জরিপ সব সময় ঠিক হয়—এমনটা নয়। নির্বাচনে সব দল নিজেদের সব সামর্থ্য দিয়েই জয়ের জন্য লড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।