UK তে মানুষকে সর্বশান্ত হবার সবচেয়ে বেশি উদাহরণ দেখেছি সলিসিটরের হাতে! সবাইকে আমি একই কাতারে মাপছি না, সেটা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। কিন্তু UKVI এর কল্যানে ইমিগ্রেশন লইয়ার যারা তাদের একটা বড় অংশ প্রতিনিয়ত মানুষকে লুটে নিচ্ছে। প্রচুর টাকা চার্জ করে তারা এবং ভিসা না হলে তাদের কিছু যায় আসে না, চার্জ করা টাকা নন-রিফান্ডেবল। যারা ভালো ইমিগ্রেশন লইয়ার, তারা চেষ্টা করে সঠিক সেবাটা দিতে। কিন্তু যারা মানুষকে সর্বশান্ত করার নেশায় মেতেছে, তারা নিত্য নতুন ‘আইডিয়া’ বের করে কীভাবে মানুষের থেকে টাকা বের করবে।
আমি যখন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি, তখন ইন্টারপ্রেটার তথা দোভাষীর কাজ করতাম। লম্বা সময় আমি গ্লাসগোর ইমিগ্রেশন ট্রাইবুনাল এবং ইমিগ্রেশন ল ফার্ম গুলোতে ইন্টারপ্রেটার হিসেবে সেবা দিয়েছি। যেহেতু আমি বাংলা থেকে ইংরেজির দোভাষী, স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশি ভাইবোনদের কেইসেই আমি নিয়মিত যেতাম।
সে সময় আমার যে অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছিল তা নিয়ে রীতিমত বই লেখা সম্ভব। আমার ওয়াইফও একই সময় দোভাষীর কাজ করতো। ফলে অনেক সময়ই রাতে ডিনারে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করতাম আর হতাশ হতাম এটা ভেবে যে মানুষগুলোর সরলতার এবং দুর্ভাগ্যের সুযোগ নিয়ে এভাবে লুটে নিচ্ছে তাদের। আপনারা অনেকেই জানেন UK তে ইন্ডিফিনিট লিভ টু রিমেইন (ILR) তথা পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাওয়া খুবই কঠিন।
অধিকাংশ সময়ই মানুষ লং রুটে ILR এর জন্যে চেষ্টা করে। এই রুটের নিয়ম হচ্ছে আবেদন করতে হলে আবেদনকারীকে অন্তত ১০ বছর কোন না কোন ভিসায় লিগ্যালি UK থাকতে হবে। এই ‘কোন না কোন ভিসায়’ কথাটার মধ্যেই ইমিগ্রেশন ল ইয়ারদের জন্যে সহজে টাকা আয়ের এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে UKVI।
সাধারণ ভিসার বেশ কিছু ক্যাটাগরি রয়েছে যেমন স্টুডেন্ট ভিসা, ডিপেন্ডেন্ট ভিসা, পোস্ট স্ট্যাডি ওয়ার্ক, ওয়ার্ক পার্মিট ইত্যাদি। এই ভিসা গুলো সুনির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে পাওয়া যায়। অনেকেই UK আসলে এই ভিসাগুলো দিয়ে ১০ বছর পূরণ করার চেষ্টা করে থাকেন। UKVI শুরুর দিকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। সহজে ভিসা দেয়। অনিয়ম করলেও এড়িয়ে যায়।
এ দেশের একটা বড় আয়ের উৎসই এই ভিসা ফিস, সাথে বছর সাতেক ধরে যুক্ত হয়েছে IHS ফিস। ফলে সাত-আট বছর অনেকেই থাকতে পারে এখানে। সমস্যাটা শুরু হয় তারপর। শেষের দুই বা তিন বছরে UKVI প্রচুর ঝামেলা করতে শুরু করে। এতে মানুষ অসাহায় হয়ে পড়ে এবং ইমিগ্রেশন ল ইয়ারদের একটা দল তখন হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যখন সাধারণ ভিসা ক্যাটাগরির সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এই ল ইয়াররা তখন দেখাতে শুরু করে বিশেষ কিছু রুট যাতে ভিসা হবার সম্ভাবনা যে আবেদন করছে তার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই থাকে না। তবুও তারা আবেদন করে কারণ ল ইয়ারের ফিসটা নন-রিফান্ডেবল। ইমিগ্রশন ট্রাইবুনালে কাজ করার সময় মূলত এই মানুষগুলোর দেখা পাই যারা UK জীবনের এই বিশেষ সময়ে অসহায় হয়ে কারাগারের মুখ দেখতে বাধ্য হয়েছেন।
এই রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়তে দেখেছি হিউম্যান রাইটস-এ। মোটামোটি সব ইমিগ্রেশন ল ইয়ার এই রুটে একটা না একটা আবেদন করে থাকে। এই গ্রুপে যারা ল ইয়ার রয়েছেন, তারা আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন এই রুটে একজন সুস্থ এবং স্বাভাবিক বাংলাদেশির পক্ষে আদৌ স্থায়ী হবার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা।
আমার তিন বছরের ট্রাইবুনালে কাজ করার অভিজ্ঞতায় কোন দিন কাউকে এই রুটে তো নয়ই, অন্য কোন রুটেও মামলা জিততে দেখি নি। এর পরের রুটটা হচ্ছে Private Life। অসহায় মানুষের মাঝে এই রুটটা ভীষণ জনপ্রিয়। এই রুটের অনেক বড় একটা ফাঁক আছে সেটা না দেখেই মানুষ এই রুটে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই রুট বলে, যদি কোন বাচ্চা UK তে এক টানা ৭ বছর থাকে এবং তার এদেশে থেকে যাবার যৌক্তিক কারণ থাকে, তাহলে সে (এবার আসছে ফাঁকটা) তার বয়স ১০ হলে ILR পাবে। এই একই যুক্তি কিন্তু বড়দের জন্যেও খাটে বলেই লং রুটটা তৈরি করা হয়েছে। দুজনের ক্ষেত্রেই ১০ বছর পর তারা ILR এ যেতে পারে।
ল ইয়াররা এই রুটটাকে ব্যাবহার করার চেষ্টা করে যারা UK তে জন্মায় নি কিন্তু এখানে এসে ৭ বছর থাকছে, তাদের ক্ষেত্রে। এরকম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে UK ছেড়ে না যাবার পেছনে কারণ রয়েছে, এটা প্রমাণ করা ভীষণ কঠিন। একটা আফগান অথবা ইরাকী বাচ্চার জন্যে এটা প্রমাণ করা যায়, একটা রোহিঙ্গা বাচ্চার জন্যেও করা সম্ভব।
কিন্তু সুস্থ একটা বাংলাদেশি বাচ্চার জন্যে এটা প্রমাণ করা ভীষণ ভীষণ কঠিন। অসংখ্য মানুষকে এই রুটে টাকা দিয়ে সর্বশান্ত হতে দেখেছি। একটু যদি আপনারা গুগলে সার্চ করেন এই লাইনটা দিয়ে uk 7 years child rule তাহলে দেখবেন শত শত সলিসিটরের ওয়েব সাইট চলে এসেছে।
এমন কি অনেক সাইটে দেখবেন ১০ বছর হবার পর যে ILR পাবে, এই কথাটা বলা নেই কিম্বা খুব ঘুরিয়ে বলে। শুধু যারা নাম করা সলিসিটর, তারাই নিয়মগুলো ভালো ভাবে বলেছে এবং এটাও বলে দিয়েছে সাকসেস রেইট খুব বেশি না। এবার আসছি আরেকটা প্রচণ্ড জনপ্রিয় রুটে। এটাকে বলা হয় Windrush Scheme।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেজা মে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (হোম সেক্রেটারি) ছিলেন, তখন একটা বড় স্ক্যান্ডাল ঘটে এ দেশে। এটাকে Windrush Scandal বলা হয়। ১৯৭৩ সনের আগে ক্যারিবিয় দ্বীপদেশ গুলো থেকে যে মানুষগুলো UK তে এসেছিলেন, তাদের অনেকের কাছে কোন ডকুমেন্ট ছিল না। ধারণা করা হয়, UKVI এর কাছে তাদের UK তে ঢোকার যে ডকুমেন্ট ছিল, তা তারা পুড়িয়ে ফেলে।
ফলে এই মানুষগুলোর আর UK তে থাকার আপাতত দৃষ্টিতে অনুমতি থাকে না। বিষয়টা অনেকের কাছে একটু জটিল লাগতে পারে। আমি একটা সরল উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। ধরুন, আপনি বাংলাদেশি। আপনার বাবা-মা, দাদা-দাদী— তাঁদের পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড অথবা বার্থ সার্টিফিকেট না থাকলেও তারা বাংলাদেশি।
এটা নিয়ে তাদের কোন দিন চিন্তিত হতে হয় নি। ঐ সময় ক্যারিবিও দ্বীপগুলো UK এর অংশই ছিল (এখনও কিছু কিছু দ্বীপ ওভারসিজ টেরিটোরি)। ফলে তাদের জন্যে এখানে আসাটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু সেই তারা এবং তাদের ছেলেমেয়েরাই হঠাৎ এদেশে অবৈধ হয়ে যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেতে একজন ভদ্রমহিলা কাজ করতেন। তাঁর দুই মেয়ে সহ তাকে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু কেন? এবং সবচেয়ে বড় কথা সে যাবে কোথায়? যাইহোক, সেই ভদ্রমহিলা এবং তাঁর মত অন্য আরো অসংখ্য মানুষ যখন অসাহায়, তখন মিডিয়া বিষয়টা নিয়ে ঝড় তোলে এবং সরকার এই উইন্ডরাশ স্কিমটা তৈরি করতে বাধ্য হয়। ফলে এই এই স্কিমে তারা আবেদন করলে নতুন করে UKVI তাদের ডকুমেন্ট দেয়।
বিভিন্ন ল ইয়াররা এই স্কিমে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি সহ আরো বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যে মানুষগুলো আবেদন করছে তারা জানেও না একজন বাংলাদেশিকে ক্যারিবিয়ান বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব না। UKVI এর কেইস অফিসার শুধু ছবি দেখেই সেটা ধরে ফেলবে।
সাকিব আল হাসানের দেশের মানুষ এবং ক্রিস গেইলের দেশের মানুষের পার্থক্যটা কোথায় সেটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। এরপর যে ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের গত দশ বছরে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে দেখেছি সেটা হলো অন্টরপ্রনর ভিসা অথবা বিজনেস ভিসা।
প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার পাউন্ড করে দিতে হয়। ল ইয়াররা সব ঠিক করে দিবে বলে কথা দেয়। তারপর আর ভিসা হয় না। রিভিউতে যায়। এটা করে, ওটা করে। ভিসা আর হয় না। ভিসা ফিস তো যেতে দেখেছিই, ঐ ১৫-২০ হাজার পাউন্ড আর ফিরে পায় না। এমন একজনকে দেখেছি যিনি একই ফাঁদে পরপর দুইবার পা দিয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার পাউন্ড খরচ করে এখনও তিনি ভিসা পান নি। আদৌ পাবেন কিনা, তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
এবার আসি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট— টিয়ার টু! অসংখ্য মানুষ আমাকে ইনবক্সে নক করে তাদের টিয়ার টু দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসবে কোম্পানী। আবার অনেকে বলে তারা স্টুডেন্ট হিসেবে UK এসেছে। কিন্তু মামা অথবা চাচা বলেছে টিয়ার টু নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে যেতে! বিষয়টা কি আসলেই এত সহজ? নাহ!
এটা হচ্ছে আরেকটা ফাঁদ। UK তে প্রচুর দুই নাম্বার টিয়ার টু ভিসা হয়। বিভিন্ন কোম্পানী রয়েছে যারা ১০-১৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে টিয়ার টু ভিসা করিয়ে দেয়। আসলে ঐ কোম্পানীর কোন অফিসই নেই। তারা লাইসেন্স নিয়ে এক বছরের মধ্যে এরকম লক্ষ লক্ষ পাউন্ড কামিয়ে হারিয়ে যায়। আর টাকা দেয়া মানুষগুলো বছরখানেকের মধ্যে পথে নেমে আসে। অন্তত পাঁচজন খুব কাছের মানুষকে এই ফাঁদে পড়তে দেখেছি।
এখন ব্রেক্সিটের পরে এরা আরো তৎপর। সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশন তাদের ফেইসবুক পেইজ থেকে পোস্ট দিয়ে এ বিষয়ে সাবধান করেছে। উপরের কোন রুটেই যখন কাজ হয় না, তখন আরেকটা রুট রয়েছে যেটায় আবেদন করার পরামর্শ দেয় ল ইয়াররা। এই রুটটা ভয়ঙ্কর। অবৈধ হয়ে আগে UK তে ১৪ বছর থাকা গেলে ILR এর জন্যে আবেদন করা যেত। বর্তমানে সময়টা ২০ বছর করেছে সরকার।
একবার যে এই রুটের কথা ভেবে ল ইয়ারের কাছে ধরা দিবে, সে মোটামোটি নিজের সর্বনাশ করে ফেলবে। অবৈধ হয়ে গিয়ে সে শুধু অসহায়ই হয়ে পড়ে না, ল ইয়ার সহ বিভিন্ন মানুষ তাদের সুযোগ নিতে শুরু করে। এদের নামে মাত্র বেতনে চাকরী দিয়ে যেভাবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে, তা আধুনিক স্লেভারির অন্যতম নিদর্শন। এমন মানুষ আমি UK এবং আয়ারল্যান্ড- দুই দেশেই দেখেছি।
আমি নিশ্চিত এই গ্রুপেও অনেকে আছেন যারা এরকম মানুষের দেখা পেয়েছেন। যাইহোক, এই লম্বা পোস্টটা লেখার একটাই কারণ। অন্যের মুখে ইমিগ্রেশনের গল্প শুনে আশায় বুক বাঁধবেন না। দিন শেষে কেবল হতাশই হতে হবে। শর্ট-কাটে যাবার চেষ্টা করবেন না। ব্রেক্সিটের পরে UK ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে।
আমার পরিচিত অনেকেই ভালো জব পাচ্ছেন। ভালো কোম্পানী থেকে সত্যিকারের স্পন্সরশিপ নিয়ে টিয়ার টু পেয়ে জব শুরু করেছেন— এমন মানুষ আমাদের রয়েছেন। তবে তারা কেউ হঠাৎ করে এই সুযোগ পায় নি। সবাইকে পড়ালেখা করে ভালো ফল করতে হয়েছে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে।
কীভাবে তা করবেন, সে বিষয়ে আমরা অতীতে ওয়েবিনার করেছি। ভাবিষ্যতেও করবো। সামনে আমরা আরো বিস্তারিত তথ্য সহ আপনাদের সাহায্য করার চেষ্টা করবো। আমরা সব সময়ই চেষ্টা করি সঠিক তথ্য জানানোর। তবে সঠিক তথ্য সব সময় সহজ পথটা বলে না। মানুষ অধিকাংশ সময় সহজ পথটা মিথ্যের মধ্যে দেখতে পায় এবং ধোকা খায়।
সে কারণে আমি সব সময় একটা কথা বলে থাকি, if it’s too good to be true, it’s possibly not true!
লিখেছেনঃ নিয়াজ চৌধুরী,
(যুক্তরাজ্য থেকে)