আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে আজ তিনি ৮৭ বছরে পা রাখতেন। ইতিহাসের এ মহানায়কের উদ্দেশ্যে আমার পুরোনো একটি লিখা এখানে তুলে ধরলাম:
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ১৯৬৫ সালের পূর্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশাধিকার ছিল খুবই সীমিত। ক্যাডেট কলেজ হতে একাডিমেক রেজাল্টের মেধা তালিকার শীর্ষস্থান অধিকারীদের অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই ও সর্বদিক বিচার বিবেচনা করে সামরিক বাহিনীতে নির্বাচিত করা হতো। আর ১৯৫৩ সালে তো সেটা ছিল আরো ছিল। কিন্তু অসাধারণ মেধাবী ও চৌকস হবার কারণে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ১২তম দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে জেনারেল জিয়া, জেনারেল সফিউল্লাহ, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোস্তাফিজুর রহমান, লেফটেনেন্ট কর্ণেল আব্দুল হামিদ, প্রাক্তন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হায়দার ও লেফটেনেন্ট কর্ণেল সৈয়দ আব্দুল হান্নান নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সালে তাঁরা কমিশন লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়া পেশাগত সুদক্ষ চৌকস অফিসার হিসেবে দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। তাঁর ক্যারিশমেটিক লিডারশিপের কারণে জিয়া তখন হতেই সিনিয়র-জুনিয়র সকলের নিকট দারূণ জনপ্রিয়। অত্যন্ত প্রিয় ও কাছের কোর্সমেট লেফটেনেন্ট কর্ণেল আব্দুল হামিদ জিয়া সম্পর্কে বলেন,“বরাবরই জিয়া ছিল মেজাজী এবং প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন একজন সৎ ও সচেতন অফিসার । কিন্তু সে অসৎ অফিসারদের কানে ধরে কাজ করাতে সুবিধা হয় বলে মনে করতো। তাঁর সাথে জেঃ ওসমানী, মোশতাক আহমদ, জেঃ খলিল প্রমুখদের বনিবনা না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে সবার সাথে একা লড়ে ফাইট করে উপরে উঠে আসে, তা ছিল সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার,লিডারশীপ কোয়ালিটির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।”
পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমিতে (পিএমএ) প্লাটুন কমান্ডার (Maker of the Officers) ছিলেন জিয়া। বাঙালীদের মধ্যে অসাধারণ মেধাবী চৌকস অফিসার ছাড়া কেউ এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না।তিনি ক্যাডেটদের নিকট ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব;ক্যাডেটগণ জিয়াকে তাদের রোল মডেল মনে করতেন। তখন থেকেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। সেই ১৯৬৫-৬৬ সালে বাঙালী জেন্টলম্যান ক্যাডেটদের তিনি বলতেন, “এমন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করো, যেন দেশ স্বাধীন হলে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিতে পারো।” একজন অফিসার কতো দূরদর্শী হলে এমন কথা বলতে পারেন। অথচ, রাজনীতিবিদগণ সে সময়ে স্বাধীনতার কথা কল্পনাও করেননি।
পেশাগত দক্ষতা ও অন্যান্য সকল যোগ্যতার মাপকাঠিতে জিয়ার অবস্থান অনেক উপরে ছিল বলেই তিনি সকল ভালো ভালো পদবীতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সামরিক দক্ষতার অনন্য নজির স্থাপণ করেন।খেমকারান যুদ্ধে জিয়া ছিলেন ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির নেতৃত্বে। দুর্ধর্ষ জিয়া ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নির্ভিক দামাল ছেলেদের নিয়ে ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইন্ডিয়ার বাহিনীর উপর। পিছু হটে শিয়ালের মতো পালিয়ে যায় ইন্ডিয়ানরা; রক্ষা পায় লাহোর।সর্বাধিক বীরত্ব সূচক পদক পায় জিয়ার কোম্পানি; তিনি ভূষিত হন ‘সিতানা-ই-জুরাত’ পদকে। বদলে যায় ইতিহাস। বীরত্বের এ অসাধারণ ইতিহাসে মুগ্ধ হয়ে পাকিস্তান সরকার ৭ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়।এরপর জিয়াকে আর পিছে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। যুদ্ধের ইতিহাসে দুঃসাহসী বীর হিসেবে তাঁর নাম সংযুক্ত হয়।এ সকল যোগ্যতার কারণে তাঁর অনেক সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ অর্জণের সুযোগ পান। ১৯৭০ সালেই জ্যেষ্টতার তালিকায় তিনি লেফটেনেন্ট কর্ণেল পদে পদোন্নতির জন্য প্রথমে ২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পরে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অত্যন্ত সুক্ষ্ম; তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার মতো একজন অসাধারণ দুঃসাহসী যোদ্ধাকেই বেঁছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। আর এ জন্যই হয়তো তিনি বদলী হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সেনাবিনাসে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে। দেশের স্বার্থে তাঁর অধিনায়কের মতো সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি পিছ পা হননি। এটা যে কত উচ্চমানের দুঃসাধ্য কঠিন কাজ তা সামরিক বাহিনীর সদস্য ব্যতীত অন্য কারো বুঝা সহজ নহে।
দেশের সেই এক দুঃসময়ে জিয়া আরো দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে প্রথমে বললেন,‘উই রিভোল্ট’ এবং পরাধীনতার নাগপাশ ভেঙ্গে বজ্রকন্ঠে ঘোষনা করলেন দেশের স্বাধীনতা। যে ঘোষণা শুনে হতভম্ব জাতি দিশা খুঁজে পেল, সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ হলেন উজ্জীবিত। একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা শুরু করলো পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট ও সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তখন হতেই দুই অক্ষরের ‘জিয়া’ নামটি সামরিক বাহিনী সদস্য ও বাঙালিদের মুখে মুখে। জিয়া ছিল এমন এক দুঃসাহসী পিলে চমকানো নাম, যে নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হৃদয় প্রকম্পিত হতো। একই ভাবে বাঙালিদের নিকট ছিল অতিপ্রিয় একজন সামরিক নেতা জিয়া। রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একজন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স প্রধান। এভাবেই হয়তো মহা পরিকল্পনাকারী মহান আল্লাহ জিয়াকে প্রস্তুত করেছিলেন সবচেয়ে সঙ্কটময় সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শহীদ জিয়া দেশের জনগণের নিকট সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা, সম্মান ও মর্যাদাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে, এখনো যে কোন ক্রান্তিলগ্নে বা সংকটের সময় দেশের মানুষ সামরিক বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
১৯৭২ সালে সিনিয়র জেনারেল জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে তাঁর জুনিয়র জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলেও সামরিক বাহিনীতে জিয়া ছিলেন অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। জেনারেল সফিউল্লাহও তাঁকে সম্মান করতেন। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানকে নির্মম ভাবে হত্যার পর দেশের অবস্থা যখন টাল-মাটাল সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৪ আগষ্ট মোশতাক সরকার জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করলেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান তখন এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর সকল সদস্য এবং রাজনীতিবিদ ও তাঁদের কর্মীগণও জিয়াউর রহমানকে দেশের সরকার পরিচালনার শীর্ষপদে আসীন করান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
এর পরের ইতিহাস সকলেরই জানা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর নিজ মেধা, কর্মধারা, দায়িত্ববোধ, সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহস ও নিখাঁদ দেশপ্রেম দ্বারা দেশ পরিচালনা করে দেশের আপামর জনসাধারণের নিকট অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দেশ ও জাতির নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতিতে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনে দেশকে বিশ্বের দরবারে এমন এক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন যে, জনগণ ফিরে পায় তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা করার অধিকার, আত্ম-মর্যাদা ও সম্মানবোধ। কিন্তু শত্রুরা চুঁপ করে বসে থাকেনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি-মাতৃভূমি বাংলাদেশের এ অকল্পনীয় উন্নয়ণের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সহ্য করতে না পেরেই দেশের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কিন্তু কালজয়ী জনপ্রিয়তা অর্জনকারী শহীদ জিয়ার জানাযায় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘শহীদি মৃত্যু নহেকো মৃত্যু নব জীবনের অভ্যূদয়’।
কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নীতি-নৈতিকতার উর্দ্ধে উঠে তিনি ছিলেন একজন গাজী সামরিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। দু’টি ভিন্ন দেশ থেকে দু’বার ২য় সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলার ইতিহাসে ক্ষমতায় থাকা যেকোনো মানুষের চেয়ে তিনি তাঁর মাতৃভূমিকে বেশি ভালোবাসেন। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরে এমন ভাবে তিনি স্থান করে নিয়েছেন যে, এদেশ যতদিন থাকবে শহীদ জিয়ার নাম স্বর্নাক্ষরে অঙ্কিত থাকবে মানুষের হৃদয়ের গভীরে।

লেখক: কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ)
নিরাপত্তা ও ইতিহাস বিশ্লেষক, সমাজসেবক ও লেখক।
hoque2515@gmail.com