“God and soldier all men adore
In times of danger and not before,
When danger is over and things are righted
God is forgotten and poor soldier is slighted.”
– Rudyard Kipling
আজ আমি এমন একজন বাঙ্গালী বীর সেনানীর কথা লিখছি যার অসম সাহসিকতা, নিখাদ দেশপ্রেম, অদম্য চেষ্টার ফসল হলো আজকের এ দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী । যে সেনাবাহিনী না হলে হয়তো বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো না। যে সেনাবাহিনী আজ পৃথিবীর সর্বত্র বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাকে উড্ডীন করেছে এবং বয়ে এনেছে আমাদের জন্য সম্মান ও গৌরবের অনন্য সব বীরত্ব গাঁথা। এ সেনাবাহিনীর যারা বীজবপণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি। মাত্র ৪২ বছরের নাতি-দীর্ঘ জীবনে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে তিনি ইতিহাসের পাতাকে রাঙিয়েছেন। এমন এক সময়ে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল যখন বাংলার মানুষ ছিল বড়ই অবহেলিত। সিংহভাগ মানুষের জীবন-যাত্রার মান ছিল নিতান্তই দরিদ্র। শিক্ষা-দীক্ষায়, ব্যবসা-বানিজ্য, সরকারি চাকুরিতে যাদের প্রবেশাধিকার ছিল নামে মাত্র।
‘বাংলাদেশ’ – আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ । এ স্বাধীনতা একদিনে কিংবা এত সহজে অর্জিত হয়নি। এর পিছনে বহু মানুষের দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা, প্রাণান্তকর চেষ্টা, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ জড়িত। পাকিস্তান হতে আমাদের স্বাধীনতার জন্য একদিকে যেমন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী ও আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। তেমনি ভাবে পাকিস্তান কায়েম হবার বহু পূর্ব হতেই তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বাংলা ও আসামের অবহেলিত মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত দুঃসাহসী কিছু বাঙালী মুসলমান সামরিক অফিসার এ ভূ-খন্ডের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে ও সামরিক বাহিনীতে নিজেদের অংশীদারীত্ব বাড়ানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এ সকল বীর সূর্য সন্তানদের অন্যতম হলেন মেজর আবদুল গণি। বঙ্গ-শার্দুল বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসেবে তিনি ‘বঙ্গ-শার্দুল’ ও ‘টাইগার গণি’ নামেই বেশি পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেন অথচ মেজর গণির অবদান সম্বন্ধে জানেন না এমন লোকের দেখা মেলা ভার।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুসলমানরা ইংরেজ ও হিন্দুদের কমন শত্রুতে পরিণত হয়। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে (ইংরেজরা একে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দেয়) ব্যর্থ হলে এর দায়ভার মুসলমানদের উপর চাপিয়ে তাদের মধ্যে চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। এ প্রসঙ্গে জহরলাল নেহেরু তাঁর “An Autobiography” -তে উল্লেখ করেন “After 1857 the heavy hand of the British fell more on the Muslims than on the Hindus. They considered the Muslims more aggressive and militant and therefore more dangerous.” ১৯৪৭ সালের পূর্বে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে বড় বড় সকল জাতি-গোষ্টির লোকদের নিয়ে তাদের জাতির বা এলাকার নামে সামরিক রেজিমেন্ট ছিল । যেমন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট, ডোগড়া রেজিমেন্ট, জাট রেজিমেন্ট, মারাঠা রেজিমেন্ট, গুর্খা রেজিমেন্ট, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, হায়দরাবাদ রেজিমেন্ট ইত্যাদি। কিন্তু ছিল না কেবল অবলা, অসহায়, অবহেলিত বাঙালী জাতির কোন রেজিমেন্ট। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে বাঙালী মুসলমানগণকে নিয়ে কিছু বাঙালী রেজিমেন্ট গঠন করা হলেও যুদ্ধ শেষে সেগুলো ভেঙ্গে দেয়া হয়। তাছাড়া বাঙালীরা বিভিন্ন রেজিমেন্টে যোগদান করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং আরো অনেক স্থানীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালী সৈনিকদের পাশাপাশি কিং কমিশনড অফিসার যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে জেনারেল মুহাম্মদ ইসফাকুল মজিদ (১৯০৩-১৯৭৩), জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন (১৯২০-১৯৯২), জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (১৯১৮-১৯৮৪), মেজর আব্দুল গণি (১৯১৫-১৯৫৭) ছিলেন অন্যতম। এ সকল অফিসারগণ বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠনের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক চেষ্টা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের চেষ্টাই বাস্তব রূপ লাভ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

১৯১৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে মেজর আব্দুল গণি জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম মেজর মোহাম্মদ আব্দুল গণি। বাবা মোহাম্মদ সরাফত আলী ছিলেন কৃষিজীবি ও মা জোবেদা খাতুন ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। জন্মের আড়াই বছর পরেই তাঁর মমতাময়ী মা ইন্তেকাল করেন। সৎ ভাই মোঃ সিদ্দিকুর রহমান সহ তাঁরা ছিলেন দুই ভাই ও দুই বোন। এম এ গণি মুসলিম ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদস্য হিসেবে ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবন-ধারার মধ্যেই শৈশব, কৈশোর জীবন অতিবাহিত করেন। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। জীবনের শুরুতেই তিনি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের উপর জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করেন । যা তাঁর বাকি জীবনের প্রতিটি কাজে এর প্রতিফলন ঘটে। কিছুদিন তিনি স্কুলেও পড়াশুনা করেন। স্থানীয় শিদলাই জুনিয়র মাদ্রাসায় পড়াশুনা শেষ ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভাল ফলাফল অর্জন করার পর তাঁকে চট্টগ্রামে ইসলামিয়া হাই মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করতেন এবং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। শৈশবেই তার মধ্যে সমাজ সেবা, খেলাধূলা ইত্যাদির প্রতি প্রবল আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় এবং এর মাধ্যমে তার নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষার সময়েই তিনি স্থানীয় ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করে খেলাধূলা, কুচকাওয়াজ, জনসেবা ইত্যাদি কর্মকান্ড নিয়ে মেতে থাকতেন। চট্টগ্রামে ইসলামিয়া হাই মাদ্রাসায় অধ্যয়ন-কালে নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে মহানবীর (সাঃ) ‘হিলফুল ফুজুল’ এর অনুকরণে গড়ে তোলেন ‘সবুজ কোর্তা’ নামে সমাজ সেবামুলক এক সমিতি। সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি এ সংগঠিত তরুণরা খেলাধূলা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করতেন। এম এ গণির মন-মানসিকতা সবসময়ই সামরিক বাহিনীর প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহকে তুলে ধরে। তাই ‘সবুজ কোর্তা’কে তিনি এমন একটি সুশৃংখল সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যার মাধ্যমে তরুণদের সামরিক রীতি-নীতির উপর প্রশিক্ষন প্রদান ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে একে আধা সামরিক বাহিনীতে পরিণত করা হয়। এর মাধ্যমে তিনি সামরিক নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে থাকেন। ‘সবুজ কোর্তা’ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজের সকল শ্রেনির মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সামাজিক কাজের পাশাপাশি এ সংগঠন বিভিন্ন সরকারি কর্মকান্ডেও সেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করতে থাকে। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রামে আন্তঃজেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এম এ গণির নেতৃত্বে সবুজ কোর্তা ও মাদ্রাসার ছাত্রদের সম্মিলিত কুঁচকাওয়াজে তিনি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। বিভাগীয় কমিশনার তাঁর সাংগঠনিক কর্মকান্ডের ভূঁয়শী প্রশংসা ও পুরস্কার প্রদান করেন।
এম এ গণির ছাত্রজীবন কেটেছে আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাঁর অমায়িক আচার-আচরণ, নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়, শিষ্টাচার, সাহসিকতা, সমাজসেবা, পরোপকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে অনেক সরকারী কর্মকর্তাগণ তাঁর হিতাকাংখী হিসেবে পরিণত হন। তাছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদা ভীরু প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তিত্ব। মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালার উপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা। তাই মহান প্রভূই তাঁর জন্য মানুষকে অছিলা হিসেবে নির্বাচিত করে দেন। এহেন আর্থিক অভাবের সময় এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের মহকুমা প্রশাসক হামিদ হাসান নোমানী, যিনি ছিলেন অবাঙালী ও অত্যন্ত উঁচু মানের মানব হিতৈষী ব্যক্তিত্ব। এম এ গণির প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবন ও সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁর প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে গণির মেধা-মনন, যোগ্যতা ও অন্যান্য গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হবে না বলে তা পরিত্যাগ করিয়ে গণিকে তিনি তাঁর ছেলের সাথে চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে ভর্তি করে এবং নিজ বাড়িতে জায়গীর হিসেবে থাকা-খাওয়া, ভরণ-পোষনের ব্যবস্থা করে দেন। ইতোমধ্যে জনাব নোমানীর খুলনা জেলায় বদলী হবার কারণে গণিকেও তিনি সাথে নিয়ে নিজ ছেলের সাথে খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৩৬ সালে এ স্কুল হতেই তিনি এন্ট্রাস পরীক্ষায় উক্তির্ণ হন। এরপর তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং এখানেও তাঁর আর্থিক সংকট ছিল । কিন্তু মহান আল্লাহই তাঁকে অভিভাবক জুটিয়ে দেন। তাঁর মামা ডাক্তার সোবহান বার্লিন ইউনিভার্সিটি হতে এম.ডি. ডিগ্রি অর্জন করে কলিকাতায় চলে আসেন এবং এগিয়ে আসেন ভাগ্নের সহযোগিতায়। ইসলামিয়া কলেজ হতে তিনি ১৯৩৮ সালে আই এ এবং ১৯৪০ সালে বিএ পাশ করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধূরী ইসলামিয়া কলেজে বিএ অধ্যয়ন-কালীন এম এ গণির সহপাঠী ছিলেন। ইতোমধ্যেই তাঁর মামা ইন্তেকাল করেন এবং বড় মামা মৌলবী আব্দুল গফুরও মারাত্মক টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হন। পুনরায় তাঁর আর্থিক সংকট শুরু হয়। কিন্তু আল্লাহর কি অসীম রহমত, বিএ পরীক্ষার পরপরই তিনি কলিকাতা ফায়ার ব্রিগেডে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং এখানে তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালী মুসলমান।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মেজর গণির শৈশব, কৈশোর, যৌবনকালে তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক পটভূমি তাঁর জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ও রেখাপাত করে। এ সময়ে বাঙালী মুসলমানগণ ছিল অবহেলিত, অশিক্ষিত, দরিদ্র জনগোষ্টী। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বানিজ্য, সরকারি চাকরি ও রাজনীতিতে তাদের কোন ভূমিকাই ছিল না। যারা ইংরেজ ও হিন্দু জমিদার, উগ্রপন্থী গোঁড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের শাসন-শোষন ও বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব ও উত্তর বঙ্গে ৭০% ভাগ মুসলমানদের জন্য কোন স্কুল-কলেজ ছিল না। শিক্ষার অধিকার যেন কেবলই হিন্দুদের জন্য । বাংলা সাহিত্যেও হিন্দু লেখকদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। মুসলমানদের প্রতি অবহেলা ও ঘৃণা জেগে উঠে তাদের অধিকাংশ লেখায়। এ সকল অবিচার ও অত্যাচারের হাত হতে রক্ষা পাবার জন্য নবাব স্যার সলিমুল্লাহর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে মুসলমান অধ্যূষিত পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হয়, ইতিহাসে যা ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিত। ফলে মুসলমানগণ উজ্জীবিত হয়ে নতুন জীবন লাভ করার মতো পরিবেশ পেতে শুরু করে। ঢাকায় ব্যবসা-বানিজ্য ও অর্থনীতির উন্নতি ও প্রসার হতে থাকে। এতে হিন্দু অধ্যুষিত কলিকাতা ম্লান হতে থাকে, হিন্দু জমিদারদের প্রভাব কমতে থাকে ও তাদের ব্যবসা-বানিজ্য শিল্প-কারখানা ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। প্রজাকুল মুসলমানদের এ উন্নতি হিন্দু জমিদার ও জাতীয়তাবাদী উগ্রপন্থীরা কোনক্রমেই সহ্য করতে পারছিল না। তাই ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ করার জন্য হিন্দু জনগোষ্টী সম্মিলিত ভাবে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু করে । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ক্ষেত্রে অগ্রনী ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন। তিনিও ছিলেন ‘বঙ্গভঙ্গ’ তথা মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। কেননা, কুষ্টিয়ার শিলাহদহে তাঁর ছিল বিশাল জমিদারী । মুসলমান প্রজাদের শোষন করার মাধ্যমেই তাঁর জমিদারী গড়ে উঠে। তাঁর নেতৃত্বে ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ আন্দোলন আরো বেগবান হয় এবং এক সময়ে তা অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত হয়। উগ্রবাদী হিন্দুরা ইংরেজদের উপর আক্রমণ শুরু করে। অপরদিকে অত্যন্ত দুর্বল, নিরীহ, অশিক্ষিত, নেতৃত্বহীন মুসলমানগণ কট্টরপন্থী হিন্দুদের আন্দোলনের বিপক্ষে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারলো না। অবশেষে ইংরেজ শাসকরা হিন্দুদের আন্দোলনের নিকট নতি স্বীকার করে ১৯১১ সালে ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ ঘোষণা করে। এতে হিন্দুদের আনন্দে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। আর অসহায় ও নিগৃহিত মুসলমানদের ভাগ্যাকাশের আলোর ঝলকানী আবার অন্ধকারে পরিণত হলো। শোষণ-বঞ্চনার এ বৈরি পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন মেজর গণি। সে সময়ে হামিদ নোমানির মতো সরকারি কর্মকর্তা ও মানব হিতৈষী ব্যক্তিত্ব এগিয়ে না আসলে এম এ গণির প্রতিভা হয়তো আলোর মুখ কখনো দেখতো না। অতএব, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন মেজর গনি তাঁর সকল ক্ষমতা ও সামর্থ দিয়ে অবহেলিত মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে কাজ করে গেছেন।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বেঁজে উঠলো, এম এ গণি আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিং কমিশন অফিসার পদে যোগদান করার জন্য আবেদন করলেন । সকল পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করার পর প্রশিক্ষনের জন্য নির্বাচিত হলে তিনি ফায়ার ব্রিগেডের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪২ সালের জানুয়ারীতে ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি কমিশন লাভ করেন। শুরু থেকেই গণি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, তীক্ষ্ন বুদ্ধিমান, নির্ভীক, বিনয়ী, কৌশলী ও কর্মতৎপর অফিসার। যা সকল সিনিয়র ব্রিটিশ অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি তাঁদের প্রিয়ভাজন অফিসারে পরিণত হন। ১৯৪২ সালের শেষ দিকে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ সময় তাঁকে বার্মার আরাকানে জাপানী আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে তিনি তাঁর তীক্ষ্ন মেধা-বুদ্ধিমত্তা, পেশাগত দক্ষতা, রণকৌশল, বীরত্ব, সাহসীকতা, সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতাকে কাজে লাগিয়ে জাপানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর পারফর্মেন্সে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ ছিলেন খুবই সন্তুষ্ট। কিন্তু বিধি-বাম। এক সময় জাপানের একটি ডিভিশন ক্যাপ্টেন গণির ইউনিটকে আক্রমণ করে চতুর্দিক হতে অবরুদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু দুঃসাহসী গণি এরকম বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দমে যাননি। বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে তিনি এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তাঁর এ অসমসাহসীকতার বর্ণনা পাওয়া যায় জনাব শামসুল আলমের লেখা থেকে: “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন গণি বার্মা ও আরাকান রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন । যুদ্ধের এক পর্যায়ে জাপানীদের দ্বারা কয়েক হাজার সৈন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাহাড়ী অঞ্চল বলে মূল বাহিনী হতে তাদেরকে খাদ্য পাঠানো খুবই অসুবিধাজনক ছিল। অত্যন্ত সাবধানতার সাথে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে কিছু খাদ্য সরবরাহ করা হ’ত। পরিশেষে পাথর সংকুল পর্বতের ভেতর দিয়ে সুরঙ্গ কেটে ক্যাপ্টেন আবদুল গণির নেতৃত্বে আটকা পড়া ১২০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী প্রতিরোধ ভেদ করে বের হয়ে আসেন।” এ বিপজ্জনক সময়ে বাঙালী মুসলমান সৈনিকদের সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখে ক্যাপ্টেন গণি দারুণ ভাবে উৎসাহিত হন এদেরকে নিয়ে একটি বাঙালী রেজিমেন্ট গঠন করতে।
মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৬ সালে ক্যাপ্টেন গণিকে ভারতের ঝালনায় কোর সেন্টারে বদলি করা হয়। এ সময় হতে তাঁর চিন্তা চেতনা কাজ করতে থাকে কিভাবে বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করা যায়। এ সময়ে তিনি দাক্ষিনাত্যের বিশাখা পট্টম, হায়দরাবাদ, সেকান্দারাবাদ ও মুম্বাইতে সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তির দায়িত্ব পালন করেন। যা তাঁর জীবনে বড় ধরনের একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজে লাগে। এখানে তিনি ১২৫৬ ও ১৪০৭ দু’টি পাইওনিয়ার কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। পূর্ব হতেই তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে চিনতেন মহাযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য। সে সুবাদে তিনি জেনারেল স্যার মেসারভিকে বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠন করার অনুরোধ জানিয়ে একটি ডেমি অফিসিয়াল পত্র লিখেন। এ পত্রের সাথে তিনি সকল তথ্য ও যুক্তি পেশ করে ২০ পৃষ্টার একটি স্মারকলিপিও পেশ করেন। মেসারভি এ প্রস্তাবকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিলেন এবং এ পত্রের উত্তরে জানান, “আমি আশা করি বিশ্বকে তোমরা দেখাতে পারবে বাঙালী মুসলমান সৈনিকরা অন্যান্য সৈনিকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।” ঝালনার কোর সেন্টারের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মারিয়াটি বাঙালী রেজিমেন্ট গঠনের বিষয়ে ক্যাপ্টেন গণিকে পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন গণির অধীনে ১২৫৬ ও ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি দু’টি বাঙালী মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ছিল বলে এগুলো পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে ক্যাপ্টেন গণির নেতৃত্বে কোম্পানি দু’টি বিশেষ ট্রেন যোগে মুম্বাই হতে ঢাকায় আনা হয়।
ঢাকায় আসার পর বাঙালী রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য ক্যাপ্টেন গণি জোর তৎপরতা শুরু করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ক্যাপ্টেন গণিকে ভালোভাবে চিনতেন এবং তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ফলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে রেজিমেন্ট গড়ার ব্যাপারে আশ্বাস প্রদান করেন। এ সময়ে হঠাৎ ক্যাপ্টেন গণিকে রংপুরে ন্যাশনাল গার্ডের অধিনায়ক হিসেবে বদলী করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই মূখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে রংপুর হতে তাঁকে নারায়নগঞ্জে রিক্রটিং অফিসার হিসেবে বদলী করা হয় বাঙালী যুবকদের সৈনিক পদে ভর্তি করার জন্য। যারা প্রশিক্ষনের পর নব গঠিত রেজিমেন্টে যোগ দিবে। তিনি এ সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগান এবং ছয় ফুট লম্বা লম্বা সুস্বাস্থ্যবান যুবকদের বেঁছে বেঁছে সৈনিক পদে ভর্তি করান, যেন অন্যান্য রেজিমেন্টের চেয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা তুলনামূলক ভাবে আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী হয়। সারা পূর্ব পাকিস্তান তিনি ঘুরে বেড়াতে থাকেন, যুবকদের উজ্জীবিত করে উপযুক্ত লোকদেরকে ভর্তি করার জন্য। কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন তিনি সঠিক ব্যক্তিকে রিক্রুট করার জন্য, যাতে পাকিস্তানের সকল রেজিমেন্ট হতে বাঙালী রেজিমেন্টের সৈনিকরা হয় সবচেয়ে উত্তম। এ সকল রিক্রুটদের ঢাকার কুর্মিটোলায় কঠোর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়।
অবশেষে বাংলার বাঙালী মুসলমানদের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত প্রাণের আকুতি, ক্যাপ্টেন গণির আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করতে শুরু করে। পাকিস্তান জন্ম লাভের শুরুতেই সরকার ক্যাপ্টেন গণি ও আরো অনেকের ইচ্ছানুযায়ী বাঙালী মুসলমানদের জন্য একটি রেজিমেন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যার নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদরদপ্তর হতে এ রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল গঠন করা জন্য পত্র জারী করা হয় । ক্যাপ্টেন গনি ও ক্যাপ্টেন এস ইউ খানকে দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা সেনানিবাসে এ ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করার জন্য । মেজর এ. ডব্লিউ. চৌধূরী ও মেজর সাজাউয়াল খানকে এ ইউনিটের দু’টি কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন গণি ও অন্যান্য অফিসারগণের আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল গঠনের সকল প্রস্তুতি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লেঃ কর্ণেল ভি. জে. ই, প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে নিযু্ক্ত করা হয়। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলায় বাঙালী মুসলমানদের বহু প্রতিক্ষিত সে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয় । এ ঐতিহাসিক দিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন ১ ইস্ট বেঙ্গল। পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন, মন্ত্রী পরিষদের সকল গুরুত্বপূর্ণ সদস্যগণ, উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইউব খান, উচ্চ পদস্থ সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলন করেন গভর্নর জেনারেল স্যার ফ্রেডারিক ব্রেবর্ন। শুরু হয় বাঙালীদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভযাত্রা এবং মার্শাল রেস হিসেবে প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ। মুছে গেল দুইশত বছরের গ্লানি। এর মাধ্যমে বীজ বপণ করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের। ‘সৌম্য, শক্তি ও ক্ষিপ্রতা’র আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে যাত্রা শুরু করে ‘বঙ্গ শার্দুল’ বাহিনী। কে জানতো যে, এ রেজিমেন্টই একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিবে !

রাজনৈতিক জীবন: মেজর গণির নতুন জীবন শুরু হয়। অযথা সময় ক্ষেপণ না করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেকে কাজে লাগানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে নেমে পড়েন। তাঁর মধ্যে শৈশব হতেই নেতৃত্বের গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া তিনি ছিলেন ইসলামী ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সুশিক্ষিত। তিনি আরবী, ইংরেজী ও উর্দু ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। কোরআন, হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাণ জাগানিয়া বক্তব্য শুনে অসংখ্য মানুষ তাঁর ভক্তে পরিণত হয়। সামরিক নেতৃত্বে সফল হতে না পারলেও তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বে উদীয়মান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বিভিন্ন কারণে তিনি বিদ্যমান কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান না করে ১৯৫৪ সালের ২২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রথম দিন হতেই তিনি এ দেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করেন। সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল অনেক সুদূর প্রসারী। তাঁর সামগ্রিক চেষ্টা ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ, সাম্য, ইনসাফ, মহত্ব ও ন্যায়নীতি কায়েম, মানুষের চারিত্রিক উন্নয়ন, জনগনের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করা এবং মানুষকে সত্য ও সুন্দরের প্রতি আহবান জানানো। তিনি নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের বন্ধু হিসেবে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। একজন আদর্শ নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায় পরায়ণ, সৎ, মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক, বিচক্ষণ, দূরদর্শী, স্পষ্টবাদী, জনদরদী ব্যক্তিত্ব। জন-প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সরকারের নিকট দেশ ও জাতির কল্যাণে বেশ কিছু দাবী উত্থাপন করেন। যেমন- দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের যুবকদের কমিশন অফিসার হিসেবে যোগদানের জন্য ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করা। সারা দেশের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা। পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবে মাটি ও মানুষের কথা তুলে ধরতেন। তাঁর বক্তব্য এতই শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় ছিল যে, প্রত্যেক সদস্য ও স্পীকার মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করতেন। প্রদত্ত প্রতিটি ভাষণে তিনি এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়ণের জন্য জোরালো বক্তব্য রাখেন। ফলে সরকার তাঁর যুক্তিপূর্ণ অনেক দাবি মেনে নেন। তিনি খেটে খাওয়া মানুষ যেমন-কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, দিন মজুর সকল অসহায় মানুষের ভাগ্যোন্নয়ণের জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে থাকেন। মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। উল্লেখ্য, মেজর আবদুল গণি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও খোদা-ভীরু খাঁটি মুসলমান। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, “Islam is not only a religion but a complete code of life.” মানুষের উপর মানুষের শোষণ, জুলুম, নিপীড়ণের হাত হতে মুক্তির পথ হিসেবে ইসলামী জীবনাদর্শকেই একমাত্র পথ হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। ইসলামকেই তিনি মানুষের জন্য একমাত্র প্রকৃত জীবন বিধান হিসেবে গণ্য করতেন। তাই তিনি একটি প্রকৃত ইসলামী দল গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিলেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘ইসলাম লীগ’। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পূর্বেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। সামরিক বাহিনীতে মাত্র বার বছর সময়ে জুনিয়র একজন অফিসার হয়েও তিনি অসাধ্যকে সাধন করে নিখাঁদ দেশপ্রেমের উজ্জল ও বিরল এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। রাজনীতিবিদ হয়েও অতি অল্প সময়ে তিনি জনগণের জন্য যা করেছেন তার তুলনা হয়তো ইতিহাসে দ্বিতীয় একটি পাওয়া যাবে না।
পারিবারিক জীবন : মেজর আবদুল গণি ১৯৪৩ সালে তাঁর বড় মামার প্রথমা কণ্যা আছিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন আদর্শ স্বামী ও স্নেহপরায়ণ পিতা। তিনি দুই পুত্র ও তিন কণ্যা সন্তানের জনক ছিলেন। প্রথম পুত্র কর্ণেল তাজুল ইসলাম গণি ও ছোট পুত্র লেঃ কর্ণেল খালেদ গণি। উভয়েই তাঁদের পিতার সৃষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন। তিন কণ্যা হলেন, মাহমুদা বেগম, হাসিনা বেগম ও সাজেদা বেগম। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুখী ব্যক্তিত্ব। তাঁর সন্তানগণ সবাই সমাজে বাবার মতো আদর্শ মানুষ।
মেজর মোহাম্মদ আবদুল গণি ধূমকেতুর মতো বাংলার আকাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন । ক্ষণজন্মা এ নির্ভীক বীরপুরুষ, সামরিক অফিসার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাত্র ৪২ বছর এ নশ্বর দুনিয়ায় বেঁচে ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ২৯, ৩০ ও ৩১ অক্টোবর তিনদিন ব্যাপী ওয়ার্ল্ড ভেটার্ন্স ফেডারেশন কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের জন্য জার্মানীর বার্লিনে গমন করেন। এ সম্মেলনে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদ্দীপনা-মূলক, উত্তেজনাপূর্ণ ও জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন। এক পর্যায়ে তিনি আকস্মিক হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ১১ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তায়ালার নিকট গমন করেন। তাঁর মরদেহ দেশে আনার পর যথাযথ সামরিক মর্যাদায় কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে দাফন করা হয়। চলে গেলেন মেজর গণি, কিন্তু রয়ে গেল তাঁর সৃষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। যা আজ পরিনত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে।


লেখক: কর্ণেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অবঃ)
Thanks for publishing this article. Let our new generation know about our forgotten history.