আড্ডা বা খোশগল্প শব্দটি শুনলেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠে নানা সুখময় সব চিত্র। ব্যক্তি,স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এ আড্ডার ভিন্নতা রয়েছে। আছে স্ব – স্ব শৈল্পিক সৌন্দর্য-মাধুর্য । আর সে আড্ডাটি যদি হয় নির্মল সাহিত্য কেন্দ্রিক; তাহলে তার তুলনা কোথায় !
বিখ্যাত হওয়াদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ রকম নির্মল আড্ডা থেকেই তারা বেরিয়ে এসেছেন । যে আড্ডায় কোন ক্লান্তি নেই, রূঢ়তা নেই, হিংসা-বিদ্বেষ-হীনমন্যতা নেই। নেই রুক্ষতা, কু-ধারণা, সংকীর্ণতা, পরনিন্দা, পঙ্কিলতা, আত্মপূজা।
কারণ– মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি ও কৃত্রিমতা দিয়ে আড্ডা হয় না । হয়তো এ সবের বাহার আছে কিন্তু বাহাদুরি নেই। চাকচিক্য আছে ; সারমর্ম নেই, জৌলুস আছে ; শুভ ফল নেই ।
যদিও আমরা গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত , সবুজ, শ্যামল, ছায়া ঘেরা, মায়া মমতায় ভরা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে দূরে; বহুতদূরে, সুদূর প্যারিসে ! এ কারণেই হয়তো গ্রাম বাংলার সে আবেদন মনের ভিতর আরো তীব্র !
এ তৃষ্ণার কিছুটা মেটাতে গত রোববার ‘কবিতায় আড্ডা’ ‘র তৃতীয় আয়োজনে পল্লীকবি জসিম উদ্দিনকে নিয়ে এ আড্ডা বসে। আড্ডায় কবির কবিতা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী ও তার জীবনের নানা দিক আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রবাসের বুকে ভেসে উঠেছিলো আবহমান বাংলার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কবি জসিম উদ্দিনকে পল্লী কবি বলা হলেও আড্ডা আলোচনা ও তার সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ মানুষের জীবন, জীবিকা, প্রথা, আচার-আচরণ, ধর্মীয় সরল বিশ্বাস, কুসংস্কার ও তাদের আবেগ অনুভূতি তুলে ধরার ভেতর দিয়ে মূলত বাংলাদেশের প্রকৃত আর্থ সামাজিক অবস্থার চিত্র গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। একটি দেশকে বুঝতে হলে সে দেশের গ্রামীণ জীবন ও সমাজকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে হয়। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন যাপন ঐ দেশের পরিচয় বহন করে। যেটা স্বার্থকভাবে মানসপটে নিয়ে এসেছেন কবি জসীম উদ্দিন।
কবির কর্মকান্ড, সাহিত্য নিয়ে নিজস্ব ধারার কথা বলতে গিয়ে কবি নিজেই বলেন,___
“আমার কবিতায় আমি বড় বড় রাজা বাদশার কাহিনী বলতে পারিনি। বড় বড় বীরের কাহিনী অবলম্বন করে কবিতা রচনা করতে পারিনি, যা আপনাদের নবজীবনের পথে নব নব উন্মাদনা এনে দিতে পারবে। গাজী সালাউদ্দিনের বড় বড় যুদ্ধের চাইতে পল্লী গ্রামের রুপা মিয়ার গ্রাম্য কাইজ্যা আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। রাতদুপুরে যখন মেঘে মেঘে শব্দ করে ঝড় আসে তখন রাত্রির অন্ধকারে মশাল জ্বালিয়ে বছিরদ্দিও মাছ ধরতে যায়, তার সেই সাহসিকতা আমাকে পাগল করে। শহরের এলায়িতকুন্তলা সুবাসিনী সুন্দরীদের পাশে আমার রচিত সাজু, দুলী, আনোয়ারা এরা যে স্থান পাবে না তা আমি জানি। এত শিক্ষা সুনিপুনা শহরের বিদুষী মহিলাদের পাশে আমার সাজুর কাঁথা সেলাইয়ের সূক্ষ্ম কারুকার্যের মূল্য কতটুকুন। কিন্তু তাজমহলের চাইতে ও আমাকে পাগল করেছে এইসব নকশী কাঁথার সুন্দর ইন্দ্রপুরী।” (সূত্রঃ- আমার দেশের কথা, ১৯৪৯)
সৃজনশীল এ সব আড্ডা যেনো শেষ না হয় । যা আত্মিক ক্ষুধা নিবারণে অনন্য এক অমিয় সুধা। এ চাওয়া টাকা – পয়সা, আভিজাত্য, ভাব- প্রতিপত্তি দিয়ে পূরণ হয় না । এ জন্য দরকার নির্মল, সজিব, উদার ,স্বর্গ-মর্ত্যসম সৃষ্টিশীলতায় পূর্ণাঙ্গ এক হৃদয়। আর এ সব আড্ডা থেকেই বেরিয়ে এসেছে জগত বিখ্যাতরা ।
আমাদের ব্রত হোক অতীতের সমৃদ্ধ – প্রাঞ্জল সব আড্ডাকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
ওয়াহিদুজ্জামান মৃধা — ফ্রান্সের প্যারিস থেকে