আষাঢ়ের বাদল-ঝরা কোনো এক দুপুর। খুব একটা জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হচ্ছে। গতরাত থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। থামবে থামবে করে সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিন্তু বৃষ্টি কী আর থামে? একটু কমলে পুণরায় দ্বিগুণ বর্ষণ শুরু হয়। শেষমেশ উপায়-অন্ত না দেখে ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।
বেশ ক’দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। পুকুর, ডোবা-নালা জলে টইটুম্বর। টানা বৃষ্টির শব্দ, শোঁ-শোঁ — শোঁ-শোঁ। চারদিক একেবারে ফাঁকা, জন-মানবহীন। রাস্তা-ঘাট জল-কাদায় পিচ্ছিল। জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে বড় বড় গর্ত হয়েছে। পানির স্রোতের কলকল শব্দ। ব্যাঙ ডাকছে। খালি-পায়ে কাদা-জল ভেঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে পড়িমরি করে গোল্লাঘাটে এসে পৌঁছলাম।
ফাঁকা টার্মিনাল। পয়সা তোলার লোকটি পর্যন্ত নেই। মনে হলো, এ কোন ভুতুরে বাড়ি এলাম! ভরদুপুরেও সন্ধ্যার মতো অন্ধকার। খুব কাছের জিনিস ছাড়া, কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। টানা বৃষ্টির শব্দে কান ঝাঁলাপালা। বারান্দায় জলের ঝাঁপটা লাগায় একটা কক্ষের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ও মাগো ! চোখ মেলে সামনে তাঁকাতেই আঁতকে উঠলাম। লাঠিয়াল সর্দার-গোছের একজন বয়ষ্ক মানুষ বেঞ্চের উপর বসা। সুঠাম দেহ। ভয়ঙ্কর চেহারা। লম্বা লম্বা গোঁফ কানের পিঠে গোঁজা। পাশে এক সুন্দরী তরুণী। ছিমছাম গড়ন। বয়স আঠারো-উনিশ হতে পারে, তবে বিশের বেশি নয়। সারা শরীর চাদরে ঢাকা। মুখ নিচু করে বেঞ্চের এককোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে।
অলীক উটকো ভয় কাটিয়ে, আমি নিজেকে সামলে নিতে চেস্টা করলাম। আমার ভীত থতমত অবস্থা দেখে, দৈত্যের মতো লোকটি সাদা ভ্রু-জোড়া কুচকে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। তারপর একগাল হাসি হেসে বললো, – বাজান, মনে হইতাছে ঢাহায় যাইবেন?
– জ্বী। মুখ দিয়ে কথা সরছিলো না আমার। তবুও ভয়ে ভয়ে বললাম।
– আমার আম্মায়ও ঢাহায় যাইবে। মেলা বড় একখান পাশ দিয়া হেরপর ডাক্তর অইবো।
– আহ গেদুমামা, তুমি থামবে !
মেয়েটা এবার নড়েচড়ে বসলো। চাদর সরিয়ে কোলে রাখা পার্স থেকে পাঁচশ টাকার একখানা নোট টেনে বের করে আনলো। তারপর মামার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, – তোমাকে না টাকাটা ভাঙ্গিয়ে আনতে বলেছিলাম, মনে নেই?
– থাকবো না ক্যান? দাও শিগগির দাও দেকি, উপরের দোকান-টুকান থাইক্যা ভাঙ্গাইয়া আনবার পারি কী না?
নোটসহ ছাতা হাতে গেদুমামা বেরিয়ে গেলেন।
আমি তখনো দাঁড়িয়ে। ভেজা ছাতা থেকে পানি ঝরছে। প্যান্টের প্রায় গিরা অবব্দি গুটানো। পেছনটা সম্পূর্ণ ভেজা। পেছনের পকেট থেকে রুমাল বের করে ভেজা জায়গা মুছে নিলাম। ঠকঠক করে কাঁপছি। তব ভয়ে নয়, ঠান্ডায়। নিশ্চয়ই ঠান্ডা-জ্বরে ভুগতে হবে। মা অনেক করে বারন করেছিলো। শুনলাম কই ? কেন যে এমন বর্ষা-কাদার মধ্যে বেড়োলাম !
-একেবারে ভিজে গেছেন?
আমি ভাবনার ঘোর থেকে ফিরে এলাম। সামনে চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম, মেয়েটি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার মুখ দিয়ে কথা সরছিলো না। তবুও অমন পটলচেরা চোখের চাহনি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, -আমাকে বলছেন?
-তবে কাকে? আপনি ছাড়া আর কেউ কী আছে এখানে?
আমি বোকার মতো হাসলাম। – না, কেউ নেই?
মেয়েটি আমার বোকা-মার্কা চেহারা দেখে গোলাপি ঠোঁটে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ হাসলো। তারপর মিষ্টি করে বললো, -দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।
(চলবে ………….)

কলমেঃ জাহাঙ্গীর আলম
©রচয়িতা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
( একটি রোমান্টিক সামাজিক উপন্যাস)