আমি হন্তদন্ত হয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে বসলাম। সে আমা থেকে সামান্য সরে বসলো। তারপর বুকের কাপড় ঠিক করতে করতে বিরক্ত মুখে বললো, -বসার আর জায়গা পেলেন না ?
আমি একেবারে চুপসে গেলাম। মুখ নিচু করে বললাম, – আপনি যে বসতে বললেন, তাই —
-তাই বলে, আপনি আমার গায়ের উপর এসে বসবেন ?
-ছড়ি। অসহায় ভংগিতে আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তারপর মেয়েটির বিপরীত পাশের বেঞ্চটিতে গিয়ে বসলাম।
মেয়েটি আবারও চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চের কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে। আমি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছি, ততক্ষণে গেদুমামা টাকা ভাংতি করে চলে এসেছে।
-এই নেও, একটা দোকানও খোলা নাই। কী যে শুরু অইছে, কবে যে এই মেঘ-বাদল থামবো, আল্লাহই জানে !
টাকা হাতে নিয়ে মেয়েটি গেদুমামাকে প্রশ্ন করলো, -তুমি কী এখন চলে যাবে?
– সঙ্গী যখন একজন পাইয়া গেছ, তাইলে আমার এহন যাওয়াডাই ভালো। তুমি কী কও?
-আচ্ছা এসো। গেদুমামাকে মেয়েটি বিদায় জানালো।
-তাইলে যাই আম্মা। সাবধানে যাইও। ঢাহা পৌছাইয়া মায়রে চিটি লেকবা। আমারা কইলাম চিন্তায় থাকুম।
– আচ্ছা। সাবধানে পা ফেলে ফেলে যেও। মাকে টেনশন করতে বারণ করো।
গেদুমামা চলে গেল। কেবিন থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় ভারি শরীরের ধাক্কায় দরজাটা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ করে উঠলো, তাতে মেয়েটির বিরক্তি আরও খানিকটা বেড়ে গেল। দেখেও না দেখার ভান করে আমি খোলা জানালায় বাইরে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
বারিধারা ঝমঝম ঝমঝম ! সারাক্ষণ একভাবে আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে। মনে হচ্ছে, কে যেন আকাশটায় বড় বড় ফুটো করে দিয়েছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অশান্ত পৃথিবীটা পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। দূরে কদমডালে কচি ফুলগুলো মনের আনন্দে বৃষ্টির ছন্দের তালে তালে হাওয়ার নূপুর পড়ে নৃত্য করছে।
-কী সুন্দর ! তাই না?
মেয়েলি কন্ঠ শুনে অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। আমার ঠিক পেছনেই সেই মেয়েটি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, জানালায় তাকানো। । অসম্ভব মিষ্টি হাসি তার মুখে। হয়তো আমারই মতো মুগ্ধ চোখে ফুলগুলো দেখছিলো, আর তাই এমন প্রশ্ন ছুড়েছে আমার দিকে।
আমি ঐ ডাগর হরিণ চোখে তাকিয়ে, না বোঝার ভান করে প্রশ্ন করলাম, -কী ?
-ফুলগুলো।
-কোথায় ? কী ফুল ?
মেয়েটি আকাশ থেকে পড়লো। সে ভেবে নিয়েছিলো আমি ঐ কদম ফুলের দিকে তাকিয়ে আছি, আর তাই হয়তো এমন প্রশ্ন করেছে। তারপর সে আমাকে হাতের ইশারায় দূরের ঐ দূরন্ত কদম ফুলগুলো দেখিয়ে বললো, – কদমফুল। ওই যে দূরে, গাছের মগডালে —
মেয়েটির ধারণা ভুল নয়। আমার চোখ এখনো সে ফুলের দিকে। তবুও নিজেকে তার কাছে ধরা দিতে নারাজ। তার পূর্বের আচরণে, আমি তার প্রতি আগ্রহটা কমিয়ে দিয়েছি। আমার অনাগ্রহ দেখে সে কিছুটা হতাশ হলো। তারপর কী যেন ভেবে, আমাদের মাঝে একটু দূরত্ব বজায় রেখে আমার বসা বেঞ্চের কোণে বসে পড়লো। আমি আড়চোখে সব দেখছি আর ভাবছি, মেয়েদের মন আকাশের রঙের মতো ‘কখনো মেঘ, কখনো রৌদ্র’।
-আপনি কিছু ভাবছেন, মনে হয় ?
-হ্যাঁ।
– কী ভাবছেন ?
-আপনাকে বলা কী ঠিক হবে ?
মেয়েটি এবার লজ্জা পেল। আর কোন কথা বললো না।
আমি হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। বারোটা নয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এখানে আছি। তবুও লঞ্চ আসছে না। কখন যে আসবে কে জানে ?
মেয়েটিও মনে হয় প্রতীক্ষায় হাঁপিয়ে উঠেছে। লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছে। বারবার ঘড়ি দেখছে। আমি তার মনের অবস্থা বোঝার চেস্টা করলাম। মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, – কতক্ষণ আগে লঞ্চ ছেড়ে গেছে বলতে পারবেন?
মেয়েটি অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। তারপর একগাল হাসি হেসে বললো, – বলতে পারলে কী, আমি এখনও এখানে বসে থাকি?
তার কথার আগামাথা কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। সাগ্রহে প্রশ্ন করলাম, – তবে ?
(চলবে ………)

একটি রোমান্টিক সামাজিক উপন্যাস,
© রচয়িতা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।